বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থায় নানাবিধ উপকরণ যেমন- ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, অনলাইন ব্যাংকিং সুবিধা, মোবাইল এ্যাপস ইত্যাদি ব্যবস্থার প্রচলন সত্ত্বেও এখনো আমাদেরকে ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত লেনদেন সম্পন্ন করতে প্রচলিত মুদ্রা ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে হয়।
আর আমাদের অজ্ঞতা বা না জানার সুযোগে কিছু অসাধু ও কুচক্রী মহল তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে জাল নোট প্রচলনের মাধ্যমে লেনদেন ব্যবস্থাকে কলুষিত করছে। যার ফলে সাধারন মানুষকে অযথা হয়রানি ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ব্যতিক্রম নয়। জাল টাকার দৌরাত্ব বিশেষ করে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান যেমনঃ ইদ, পূজা প্রভৃতি সময়ে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। তাই আমি আজ চেষ্টা করব আসল নোটের মূল কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করতে যাতে আমরা সহজেই আসল ও জাল ব্যাংক নোট-এর পাথর্ক্য বুঝতে পারি এবং ভবিষ্যতে জাল নোটের হয়রানি থেকে মুক্তি পেতে পারি।
Read Also: How to exchange soil notes or mutilated bank notes from banks in Bangladesh?
আসল নোটের বিশেষ বৈশিষ্ট্যঃ
আসল নোটের মধ্যে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে যা একটু ভালভাবে খেয়াল করলেই বোঝা যায়। সেগুলি হল;
১. নোটের কাগজ।
২. রং পরিবর্তনশীল হলোগ্রাফিক সুতা।
৩. রং পরিবর্তনশীল কালি।
৪. জলছাপ।
৫. অতি ছোট আকারের লেখা।
৬. ইন্টাগ্লিও লাইন।
৭. অন্ধদের জন্য বিন্দু।
৮. লুকানো ছাপা।
৯. অসমতল ছাপা।
১০. পশ্চাদপট মুদ্রণ।
১১. নোটের পিছন ভাগ।
১২. ইরিডিসেন্ট স্ট্রাইপ।
১৩. নোটের সাইজ।
নিচে আসল নোটের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলির বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হলঃ
১. নোটের কাগজ।
আসল নোটের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল নোটটি সিনথেটিক ফাইবার মিশ্রিত অধিক টেকসই কাগজে মুদ্রিত। টাকাটি মুষ্ঠির মধ্যে ভাজ করে ছেড়ে দিলে আপনা আপনি ভাজ খুলে যাবে।
২. রং পরিবর্তনশীল হলোগ্রাফিক সুতা।
আসল নোটের বাম পাশে ৪ মিলিমিটার চওড়া নিরাপত্তা সুতা যাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো ও নোটের মুল্যমান ১০০০,৫০০,২০০,১০০ লেখা থাকবে। সরাসরি তাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো সুতার চারটি স্থানে মুদ্রিত আছে ও নোটের মুল্যমান ১০০০,৫০০,১০০ লেখা সাদা দেখাবে কিন্তু পাশ থেকে দেখলে বা ৯০ ডিগ্রী ঘুরালে তা কালো দেখাবে। ২০০ টাকা মূল্যমান নোটের নিরাপত্তা সুতা লাল হতে সবুজ রঙে পরিবর্তন হবে। এ নিরাপত্তা সুতা অনেক মজবুত যা নোটের কাগজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নখের আঁচড়ে বা দুমড়েমুচড়ে নিরাপত্তা সুতা কোনোক্রমেই উঠানো সম্ভব নয়।
৩. রং পরিবর্তনশীল কালি।
উপরের ডানদিকের কোনায় OVI (Optically Variable Ink) অংশে ১০০০ টাকায় ১০০০ লেখাটি সরাসরি তাকালে সোনালী এবং তির্যকভাবে তাকালে সবুজ রং দেখা যাবে, ৫০০ টাকায় ৫০০ লেখাটি সরাসরি তাকালে লালচে এবং তির্যকভাবে তাকালে সবুজ রং দেখা যাবে, ২০০ টাকায় ২০০ লেখাটি সরাসরি তাকালে সোনালী এবং তির্যকভাবে তাকালে সবুজ রং দেখা যাবে, ১০০ টাকায় ১০০ লেখাটি সরাসরি তাকালে সোনালী এবং তির্যকভাবে তাকালে সবুজ রং দেখা যাবে।
৪. জলছাপ।
আসল নোটের কাগজে মুদ্রণের সময় জলছাপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। প্রতিকৃতির নিচে অতি উজ্জ্বল ইলেক্ট্রোটাইপ জলছাপে নোটের মুল্যমান ১০০০,৫০০,২০০,১০০ লেখা আছে এবং জলছাপের বামপাশে বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো অতি উজ্জ্বল ইলেক্ট্রোটাইপ জলছাপে মুদ্রিত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম এবং নোটের মূল্যমান বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির তুলনায় উজ্জ্বল দেখায়।
৫. অতি ছোট আকারের লেখা।
১০০০ টাকায় নিরাপত্তা সুতার বামপাশে খালি চোখে পরপর দুটি সরলরেখা দেখা যাবে, যেগুলোর একটিতে 1000 TAKA এবং অন্যটিতে BANGLADESH BANK বারবার মুদ্রিত রয়েছে। আর ৫০০ টাকায় নিরাপত্তা সুতার বামপাশে খালি চোখে পরপর ১টি সরলরেখা দেখা যাবে, যাতে BANGLADESH BANK বারবার মুদ্রিত রয়েছে। লেখগুলো ছোট ফন্টে মুদ্রিত হওয়ায় আতশী কাঁচ ব্যতীত খালি চোখে দেখা যাবে না।
৬. ইন্টাগ্লিও লাইন।
১০০০,৫০০,২০০,১০০ মুল্যমানের আসল নোটের ডানদিকে আড়াআড়িভাবে ইন্টাগ্লিও কালিতে ৭টি সমান্তরাল লাইন টানা আছে। যা হাত দিয়ে সহজেই অনুভব করা যাবে।
৭. অন্ধদের জন্য বিন্দু।
আসল নোটের ক্ষেত্রে অন্ধ ব্যক্তিদের চেনার সুবিধার্থে নোটের ডান দিকে একশ টাকার নোটে তিনটি, পাঁচশ টাকার নোটে চারটি এবং এক হাজার টাকার নোটে পাঁচটি ছোট বৃত্তাকার ছাপ আর ২০০ টাকার নোটে তিনটি ত্রিভুজ আঁকা আছে, যা হাতের আঙ্গুলের স্পর্শে অসমতল অর্থাৎ উঁচু-নিচু বলে মনে হয়। এসব বৈশিষ্ট্য জাল নোটে সংযোজন করা সম্ভব নয়।
৮. লুকানো ছাপা।
আসল নোটের নিচের বর্ডারে লুকানো অবস্থায় নোটের মুল্যমান ১০০০, ৫০০, ১০০ লেখা থাকবে আর ২০০ টাকার ক্ষেত্রে TWO HUNDERD TAKA লেখা থাকবে যা আনুভূমিকভাবে ধরলে দেখা যাবে।
৯. অসমতল ছাপা।
আসল নোটের সামনের দিকে ইন্টাগ্লিও কালিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি মুদ্রিত থাকবে। তাছাড়া ১০০০,৫০০,২০০,১০০ মুল্যমানের নোটের সামনের ও পিছনের পিঠের ডিজাইন, মধ্যভাগের লেখা, নোটের মূল্যমান এবং আড়াআড়িভাবে মুদ্রিত সাতটি সমান্তরাল সরল রেখা হাতের আঙ্গুল দিয়ে ঘষলে এসব ডিজাইন, লেখা ও রেখা অসমতল বা খসখসে অনুভূত হয়।
১০. পশ্চাদপট মুদ্রণ।
১০০০ ও ৫০০, ১০০ টাকা মূল্যমান নোটের সামনের দিকে মাঝ বরাবর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের স্বাক্ষরের উপরে জলছাপ আকারে হালকা অফসেটে জাতীয় স্মৃতিসৌধ ছাপা আছে।
১১. নোটের পিছন ভাগ।
১০০০ টাকার নোটের ক্ষেত্রে পিছনের দিকে ইন্টাগ্লিও কালিতে জাতীয় সংসদ ভবন মুদ্রিত আছে, ৫০০ টাকার নোটের ক্ষেত্রে পিছনের দিকে ইন্টাগ্লিও কালিতে বাংলাদেশের কৃষি কাজের ছবি মুদ্রিত আছে যা হাতের স্পর্শে অসমতল অনুভূত হবে।
১২. ইরিডিসেন্ট স্ট্রাইপ।
১০০০ টাকার নোটের ক্ষেত্রে পিছনের দিকে ইরিডিসেন্ট স্ট্রাইপে BANGLADESH BANK লেখা আছে। নোটটি নাড়াচাড়া এর রং পরিবর্তন হবে।
১৩. নোটের সাইজ।
১০০০ টাকার নোটের সাইজ ১৬০*৭০ মিলিমিটার, ৫০০ টাকার নোটের সাইজ ১৫২*৬৫ মিলিমিটার, ২০০ টাকার নোটের সাইজ ১৪৬*৬৩ মিলিমিটার
প্রতিটি নোটের ক্ষেত্রেই নোটের উভয় পাশের অধিকাংশ লেখা ও ডিজাইন ইন্টাগ্লিও কালিতে মুদ্রিত হওয়ায় আঙুলের স্পর্শে অসমতল বা উচুনিচু অনুভূত হবে। আসল নোট ও জাল নোট সনাক্ত করার ক্ষেত্রে UV লাইটযুক্ত জালনোট সনাক্তকারী মেশিন, মোবাইল এ্যাপস ও আঁতশী কাঁচ দ্বারা নোটের এ বৈশিষ্ট্যগুলি অতি সহজেই সনাক্ত করা সম্ভব।
জাল নোট প্রদানকারীর শাস্তির বিধানঃ
নোট জাল করা, জাল নোটের ক্রয়-বিক্রয়, পাচার বা ব্যবহার গুরুতর অপরাধ, “জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ আইন, ২০২০” অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী জাল নোট শনাক্ত হলে জাল নোটসহ উপস্থাপনকারীকে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে সোপর্দ করতে হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকটতম কার্যালয়কে অবহিত করতে হবে। ব্যাংক কর্মকর্তারা যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, উপস্থাপনকারী এটিকে সরল বিশ্বাসে উপস্থাপন করেছেন তাহলে জাল নোটটি বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
বাজেয়াপ্ত করার সময় নোটের ওপর ‘জাল’ সিলমোহর লাগাতে হবে। অথবা লাল কালিতে বড় অক্ষরে ‘জাল’ শব্দটি লিখতে হবে। জাল নোটের অপরপিঠে উপস্থাপনকারীর নাম, পিতার নাম, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, পূর্ণ স্বাক্ষর ও তারিখ লিখতে হবে। কার কাছ থেকে তিনি নোটটি পেয়েছিলেন সে ব্যাপারে তার লিখিত বিবৃতি নিতে হবে। উপস্থাপনকারী নিরক্ষর হলে তার বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুলের ছাপ নিতে হবে।
অধিকতর তদন্ত করার জন্য জালনোট এবং জাল নোটের উপস্থাপনকারীর বিবৃতি আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করতে হবে। তদন্ত শেষে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ জাল নোট ও তদন্ত প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি অফিসার বরাবর প্রেরণ করবেন।
FAQs:
১. জাল নোট কিভাবে চিনব?
যেকোন মুল্যমানের নোটে যদি নোটের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলি বিদ্যমান না থাকে, যেমন- ১. নোটের কাগজ, ২. রং পরিবর্তনশীল হলোগ্রাফিক সুতা, ৩. রং পরিবর্তনশীল কালি, ৪. জলছাপ, ৫. অতি ছোট আকারের লেখা, ৬. ইন্টাগ্লিও লাইন, ৭. অন্ধদের জন্য বিন্দু, ৮. লুকানো ছাপা, ৯. অসমতল ছাপা, ১০. পশ্চাদপট মুদ্রণ, ১১. নোটের পিছন ভাগ, ১২. ইরিডিসেন্ট স্ট্রাইপ, ১৩. নোটের সাইজ, তাহলে সেটি জাল নোট।
২. জাল নোট প্রদানকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি কি?
জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ আইন, ২০২০ অনুযায়ী জাল নোট প্রদানকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
৩. জাল নোট সহজে সনাক্ত করার জন্য কি ব্যবহার করা হয়?
আসল নোট ও জাল নোট সনাক্ত করার ক্ষেত্রে UV লাইটযুক্ত জালনোট সনাক্তকারী মেশিন, মোবাইল এ্যাপস ও আঁতশী কাঁচ দ্বারা নোটের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলি অতি সহজেই সনাক্ত করা সম্ভব।
Important Circulars:
01. জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ আইন, ২০২০
02. The Penal Code, 1860 (Act No. XLV of 1860)
Useful Links:
1. https://www.bb.org.bd/en/index.php/currency/securityfeature